জামায়াত-শিবির নিয়ে আগে বিতর্কিত মন্তব্য করা সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সোহরাওয়ার্দী হল শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি হয়ে আলোচনায় এসেছেন নিয়ামত উল্লাহ ওরফে আবরার ফারাবী নামে এক শিক্ষার্থী। এ সংক্রান্ত কিছু পোস্টের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়েছে। এরপরই বিভিন্ন মহলে বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও এ শিবির নেতা তাকে নিয়ে উঠা বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। আজ সোমবার (২১ জুলাই) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক দীর্ঘ স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান।
আবরার ফারাবীর ফেসবুক স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:
২০২০ সালের জানুয়ারিতে আমি আরবি বিভাগে ভর্তি হয়ে আমার এলাকার এক ভাইয়ের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী হলে উঠি। কিন্তু মাত্র ২৪ দিনের মধ্যে আমার রুম চারবার পরিবর্তন করা হয়। কোভিডের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে সবার মতো আমিও বাড়ি চলে যাই। ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর কিছুদিন সোহরাওয়ার্দী হলে এবং ২০২২ সালের ১৭ই জুন পর্যন্ত আব্দুর রব হলে অবস্থান করি এবং সবার মতো ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথেই হলে থাকি।
তবে তখন আমার ছাত্রশিবিরের কোনো দায়িত্বশীলের সাথে যোগাযোগ ছিল না এবং ইচ্ছাকৃতভাবেও করিনি। সে সময় আমার জীবনে কিছু পরিবর্তন আসে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নামাজে অবহেলা ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। পরে তাবলিগের ভাইদের সাথে উঠাবসা এবং তালিম-মাশোয়ারায় অংশ নেওয়া শুরু করি এবং ছাত্রশিবিরের বর্তমান বায়তুল মাল সম্পাদক মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হয় এবং তার মাধ্যমেই আমি সংগঠনে আসি। এক পর্যায়ে, হলে থাকা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
২০২২ সালের ২২শে জুন ভারতের নবীন জিন্দাল ও নুপুর শর্মা মহানবী (সা.)-কে অবমাননা করলে চবিয়ান দ্বীনি পরিবার শহীদ মিনারে মানববন্ধনের আয়োজন করে। তৎকালীন প্রশাসন মানববন্ধনের অনুমতি না দেওয়ায় আমি তাদের সাথে তর্কে জড়াই। এর ফলে আমাদের তিনজনের স্টুডেন্ট আইডি কার্ড নিয়ে নেওয়া হয়।
অবশেষে আমরা মানববন্ধন সফলভাবে সম্পন্ন করি। এই ঘটনার জেরে এবং হলে না থাকার কারণে তখন আমাকে শিবিরকর্মী বলে সন্দেহ করা হয়। অথচ তখনও আমি ছাত্রশিবিরের সাথে যুক্ত হইনি।
চবিয়ান দ্বীনি পরিবারের সাথে একে একে দাওয়াতি কার্যক্রম এবং ক্যাম্পাসে ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টিতে কাজ করে যাই। ২০২৩ সালে আমি ছাত্রশিবিরের সাথে যুক্ত হই এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করি। পাশাপাশি একটি মানবাধিকার সংগঠনে কাজ করি। ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে দুইটি বড় সংহতি সমাবেশ করি, যার একটিতে আমি সঞ্চালক এবং আরেকটিতে আহ্বায়ক ছিলাম।
ফিলোসফি বিভাগের প্রফেসর মোজাম্মেল স্যার আমাদের মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করায় আমাকে শিবিরকর্মী বলে আখ্যায়িত করা হয় (সেসময় আমি সত্যিই ছাত্রশিবিরের সাথে যুক্ত ছিলাম)। আমার ক্লাস বন্ধ হয়ে গেলেও আমি আমার দাওয়াতি ও সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাই। তবে মাঝে মাঝে পিঠ বাঁচাতে কিছু পোস্ট করেছিলাম।
২০২৪ সালে যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতার কর্মসূচি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, তখন আমি মোহাম্মদ আলী ভাইয়ের পরামর্শে চবিতে গণইফতারের ডাক দেই। এতে আমার ছাত্রশিবির পরিচয় প্রকাশিত হয় এবং আমি পুরোপুরি ক্যাম্পাস আউট হয়ে যাই। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আমি সোহরাওয়ার্দী হলের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
৫ই জুন, সরকার যখন আবারো কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের চেষ্টা করে, তখন চবিয়ান দ্বীনি পরিবারের সাথে মিটিং করে আমরা আন্দোলন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিই। “কোটা পুনর্বহাল চাই না” নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করি। প্রথম দিকে লোকবল একেবারেই কম থাকায় আমাদের জনশক্তিকেই মিছিলে পাঠাই। এরপরের ইতিহাস আপনারা সকলেই জানেন।
এখন বিতর্কিত কিছু বিষয় নিয়ে আমার বক্তব্য:
প্রথমত, আমরা কী পোস্ট করব তা আমাদের সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হত না। ছাত্রলীগের বড় ভাইয়েরা গ্রুপে পোস্ট দিতেন এবং সবাইকে সেটি শেয়ার ও ট্যাগ করতে বলতেন। আমার সে সূযোগ ছিল না যে পোস্টগুলো কাটছাঁট করব। যেভাবে ওরা লিখত সেভাবেই পোস্ট করতে হত।আর তখনও আমি ছাত্রশিবিরের কোনো ভাইয়ের সাথে পরিচিত ছিলাম না।
তবুও স্বীকার করছি, সেই পোস্টগুলো এবং নিকৃষ্ট শব্দচয়ন করা আমার ভুল ছিল। এজন্য আমি চবি শিবিরের বর্তমান ও তৎকালীন দায়িত্বশীলদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
অনেকে প্রশ্ন করেছেন: “সেই পোস্ট ডিলিট করিনি কেন?”
উত্তর হচ্ছে—আমি জানতামই না এমন একটি পোস্ট আমি করেছিলাম। গতকাল বিষয়টি সামনে আসায় দেখলাম।
আর আমার আগের আইডিটা আজকে অনেক দিন যাবৎ আমার নিয়ন্ত্রনে নেই। একবার হ্যাক হওয়ার পর জিডি করে এপিবিএন পুলিশের মাধ্যমে আইডি উদ্ধার করি এবং এর কিছুদিন পর কোনো এক অজানা কারণে আইডিতে আর লগইন করতে পারিনি।
আজম নাছিরের সাথে ছবির ব্যাপারে বলতে চাই—সেটি এসোসিয়েশনের কাজে আমাদের একজন উপদেষ্টার সাথে দেখা করতে গিয়ে তোলা হয়েছিল। তিনি আজম নাছিরের বন্ধু ছিলেন। ওই ছবিতে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক অনেক ভাইই উপস্থিত ছিলেন।
সারসংক্ষেপে বলব:
ছাত্রলীগের সাথে হলে থাকা আমার উচিৎ হয় নাই যদিও এছাড়া দ্বিতীয় অপশন আমার কাছে ছিল না। ক্যাম্পাসের প্রথম দিন থেকেই সচেতন থাকা উচিত ছিল। তবে আমার জানা মতে, আমার দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বরং আমার এক রুমমেট সে সময় ছাত্র অধিকার ও আরেকজন ছাত্রদল করত, যা আমি জানতাম এবং তাদের সাহসী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশংসা করেছিলাম।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে দেখা যায়, এন ইউ আবরার ফারাবী নামে অ্যাকাউন্ট থেকে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট বেশকিছু পোস্ট ও জামায়াত-শিবির নিয়ে বিতর্কিত পোস্ট করেছেন এ শিবির নেতা। এসব পোস্টে নিষিদ্ধ সংগঠন শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হয়।
এছাড়া ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে দেখা যায় আবরারকে। ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি জামায়াত-শিবিরকে খুনি সম্বোধন করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। এছাড়া ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি তার ফেসবুক পোস্টে ছাত্রলীগের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতা ড. রবিউল হাসান ভুঁইয়া (সাবেক প্রক্টর) শিবিরের মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন বলেও উল্লেখ করেন।
তবে তার ফেসবুক আইডি ঘুরে সাম্প্রতিক পোস্টগুলোয় দেখা যায়, তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থানের অনেক আগ থেকেই তিনি ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত।