সিরাজগঞ্জ পৌরসভার মাছুমপুর ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা সোহানুর রহমান রঞ্জু ছিলেন একজন সাহসী আন্দোলনকর্মী, যিনি ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে শহীদ হন। তিনি পৌর যুবদলের সহ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
গত বছরের ৪ আগস্ট সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে স্ত্রী মৌসুমীকে বলেছিলেন, আমার মেয়েটিকে দেখে রেখো।
আজ তার দুই বছরের কন্যা সুমাইয়া খান রোজা প্রতিদিন মাকে প্রশ্ন করে, বাবা কই? বাবা কবে আসবে? প্রতিদিন সে মোবাইলে বাবার ছবি দেখে, আর একটি শার্ট জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে— বাবা কবে আসবে?
রঞ্জু ছোটবেলা থেকেই নম্র ও সহানুভূতিশীল মানুষ ছিলেন। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো ছিল তার অভ্যাস। ঢাকায় একটি ডেন্টাল ক্লিনিক চালানোর পর নিজ শহর সিরাজগঞ্জে ‘খান ডেন্টাল’ নামে একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা এসে সাধারণ মানুষকে সেবা দিতেন। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় রঞ্জু পরিবারে ছিলেন একমাত্র উপার্জনকারী। রঞ্জুর বাবা মো. মাজেদ খান ও মা শামসুন্নাহার বহু আগেই মারা গেছেন।
গত বছরের ৪ আগস্ট সকাল ১০টায় সিরাজগঞ্জ শহরে মিছিল শুরু হলে রঞ্জু তাতে অংশ নেন। মিছিলটি এক ঘণ্টা পর মাহবুব শপিং কমপ্লেক্সের সামনে পৌঁছালে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা মিছিলে গুলি চালায়। একটি গুলি তার ডান চোখে লাগে এবং মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শহীদ রঞ্জুর দাফন হয় ৬ আগস্ট, সিরাজগঞ্জের কান্দাপাড়া কবরস্থানে। তার মৃত্যুতে কন্যা রোজাকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্ত্রী মৌসুমী। রোজা আজও জানে না, তার বাবা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।
মৌসুমী বলেন, রোজাকে শান্ত করতে আমাকে নানা রকম মিথ্যে আশ্বাস দিতে হয়। বাবা কাজে গেছে, বাবা আসবে— এসব বলে তাকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো এখন নিত্যদিনের বিষয়। কিন্তু নিজের চোখের পানি লুকিয়ে রাখতে হয় মেয়ের সামনে। হৃদয়ের ভার যেন দিন দিন আরও বেড়ে যাচ্ছে।
মৌসুমী এইচএসসি পাস করেছেন। প্রতিবেশী ও রঞ্জুর পরিবার মনে করেন, কোনো চাকরি পেলে অন্তত মেয়েটিকে নিয়ে বাঁচার একটা সুযোগ পাবেন তিনি। কিন্তু স্বামীর মৃত্যু যে শূন্যতা রেখে গেছে, তা আর কোনো কিছুতেই পূরণ হবে না। বাবার মুখ দেখতে চাওয়া ছোট্ট রোজার কান্না যেন এই সমাজকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে— একটি প্রাণ হারিয়ে কতগুলো জীবন আজ ছিন্নভিন্ন।