Saturday, July 26, 2025

জুলাইয়ের এই দিনে আন্দোলনের দাবানল জ্বলে ওঠে চট্টগ্রামে

আরও পড়ুন

সাইরেন বাজিয়ে একের পর এক আসছে অ্যাম্বুলেন্স। কাউকে আনা হচ্ছে রিকশা, অটোরিকশা কিংবা ভ্যানে করে। কারও পায়ে গুলি, কারও মাথা কিংবা শরীরের বিভিন্ন অংশে। কাউকে কোপানো হয়েছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে। সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হতাহত মানুষদের উদ্ধারে স্থানীয়দের পাশাপাশি কাজ করছে রেড ক্রিসেন্ট। অধিকাংশ আহতকে প্রথমে নেওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে।

গত বছরের ১৬ জুলাই ভয়াবহ এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল চমেক হাসপাতালের মর্গে। বছর ঘুরে ফিরে এলো সেই দিনটি। কোটা বাতিলের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন কয়েক দিনের মধ্যেই সরকার পতনের দাবিতে রূপ নেয়। রক্তস্নাত সেই আন্দোলনেই শেষ পর্যন্ত পতন ঘটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের।

জুলাই মাসের শুরু থেকে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও শুরু হয় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন। শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এই আন্দোলন ধীরে ধীরে শহরে বিস্তার লাভ করে। ১৬ জুলাই ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকায় একটি বড় সমাবেশের ডাক দেয় আন্দোলনকারীরা। সমাবেশ প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা।

হুমকি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। ওই দিন শহীদ হন ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, ছাত্রশিবির নেতা ফয়সাল হোসেন শান্ত এবং দোকান কর্মচারী ফারুক।

বৈষম্যবিরোধী নেতারা বলেন, সেদিনের পর থেকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন শিক্ষার্থীরা, আন্দোলন নেয় নতুন রূপ।

বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কত ভারী, সেটা যে সন্তান হারিয়েছে শুধু সে-ই বুঝবে। মা হারিয়েছি, দুই মাস পর ছেলেকেও হারিয়েছি। আমি ওয়াসিমসহ সকল গণহত্যার বিচার চাই। আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। ভাই হারানোর যন্ত্রণা আমার অন্য সন্তানদের মধ্যে। কেউ আমাকে ছাড়তে চায় না। বাকি জীবনটা তাদের বুকে আগলে রেখেই কাটিয়ে দিতে চাই
শহীদ ওয়াসিমের বাবা শফি আলম
আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা জানান, তারা সেদিন বিকেলে ষোলশহর রেলস্টেশনে বিক্ষোভ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে শতাধিক কর্মী সেখানে এসে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হুমকি ও উসকানি দেওয়ার পর শিক্ষার্থীরা স্থান পরিবর্তন করে মুরাদপুর মোড়ে অবস্থান নেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা সেখানে হামলা শুরু করে।

আরও পড়ুনঃ  প্রধান উপদেষ্টার পাশে থাকার আশ্বাস দিল যে চার দল

ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে চলে সংঘর্ষ। শহীদ হন তিনজন। হামলার মূল অভিযুক্ত ছিলেন যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। হামলার সময় তার সঙ্গে ছিলেন যুবলীগের মো. ফিরোজ, মোহাম্মদ জাফর, এইচ এম মিঠু, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মো. দেলোয়ার ও ছাত্রলীগ নেতা আহনাফসহ অনেকে।

আমার ছেলে আমার বুকের ধন ছিল। আমার ছেলের কষ্ট হবে, এজন্য আমি শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাকে কোনো কাজে হাত দিতে দিতাম না। আমার ছেলেটাকে ছেড়ে আমাকে একটা বছর কাটাতে হচ্ছে, সারাজীবন কাটাতে হবে, এ দুঃখ আমি কীভাবে সইব
শহীদ শান্তর মা কোহিনূর বেগম
ওয়াসিম, শান্ত ও ফারুকের পরিবার আজও স্মৃতির রক্তাক্ত ক্ষত বয়ে চলেছে। ওয়াসিমের মা ছেলের মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন। ফয়সাল হোসেন শান্তর মা কোহিনূর বেগম প্রতিদিন কাঁদেন। শহীদ পরিবারের দাবি- এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক।

সেই দিনের কথা স্মরণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের তৎকালীন সমন্বয়ক মশিউর রহমান বলেন, ১৫ তারিখে প্রথম প্রতিরোধের পর নুরুল আজিম রনিসহ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফেসবুকে ‘মেরে ফেলব, কেটে ফেলব’–এ ধরনের পোস্ট দিতে শুরু করে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের অস্ত্রের ছবি তুলে আমাদের ইনবক্সে পাঠাতে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, আমরা যাতে ভয় পেয়ে ষোলশহরে আর না যাই। কিন্তু আমরা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ছাত্রলীগ হামলা করতে এলে জোরালোভাবে প্রতিরোধ করা হবে।’

আরও পড়ুনঃ  যেখানেই মব দেখবেন সেখানেই উচিত শিক্ষা দেবেন: ইশরাক

আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা বলেন, ‌‌শান্তিপূর্ণভাবে আমরা মুরাদপুর মোড় ও রেলগেট এলাকায় অবস্থান করছিলাম। বিনা উসকানিতে ছাত্রলীগ অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। আমরা সংগঠিত হয়ে জবাব দেই। প্রথমে কিছুটা ছত্রভঙ্গ হলেও দ্রুতই প্রতিরোধ গড়ে তুলি। কিন্তু সেই সময়গুলি গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঘটনা স্থালে হাজির হয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা।

আন্দোলনে অংশ নেওয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) শিক্ষার্থী এস এম আব্দুস শাকুর বলেন, ১৬ জুলাই প্রথমে আইআইইইসির শিক্ষার্থীরা সীতাকুণ্ডে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে। সারা দেশে এটি আলোচনা হয়। এরপর আমরা বাসযোগে বায়েজিদ সংযোগ সড়ক দিয়ে চট্টগ্রামের ২ নম্বর গেট এলাকায় পৌঁছাই। ওইদিন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর হামলা করে। আমি নিজেও আহত হয়েছিলাম। একপর্যায়ে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলি।

হামলা চলাকালে সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অবস্থানে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের তৎকালীন সেক্রেটারি ও বর্তমানে সভাপতির দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকেই দুই ভাগে বিভক্ত ছিলাম। একাংশ মুরাদপুর মোড়ে আরেকাংশ রেললাইনের দিকে। হামলার শুরুতে মুরাদপুরের অংশ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া করতে করতে বহদ্দারহাটের দুই ফ্লাইওভারের মাঝখানে অবস্থান নেই। আরেক অংশ রেললাইন থেকে এসে হামলা প্রতিহত করে, সেখানেই শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্তর যুবলীগ ক্যাডারদের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন। অপরদিকে আমরা বহদ্দারহাটের দুই ফ্লাইওভারের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ চালাতে থাকি।

আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান। নিজ এলাকার ওয়াসিমকে হারিয়ে সেদিন তার বিলাপ করার দৃশ্য দেখে আবেগে আপ্লুত হয় অনেকেই। তিনি বলেন, ওয়াসিমসহ ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নিয়ে চট্টগ্রামে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় আমরা ছিলাম নিরস্ত্র। ওয়াসিমদের রক্তে সেই আন্দোলনে নতুন মোড় নেয়। এককথায় আন্দোলন ঘুরে যায়। দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে।

আরও পড়ুনঃ  ছাত্রলীগ থেকে কেন ছাত্রশিবিরে— সেই নেতার দীর্ঘ স্ট্যাটাস

জানা যায়, চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন ওয়াসিম আকরাম। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আকস্মিক সন্তান হারানোর আঘাত সইতে না পেরে শোকস্তব্ধ ওয়াসিমের মা হারিয়েছেন শ্রবণশক্তি, একবছর ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী তিনি।

ওয়াসিমের বাবা শফি আলম বলেন, ‌বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কত ভারী, সেটা যে সন্তান হারিয়েছে শুধু সে-ই বুঝবে। মা হারিয়েছি, দুই মাস পর ছেলেকেও হারিয়েছি। আমি ওয়াসিমসহ সকল গণহত্যার বিচার চাই। আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। ভাই হারানোর যন্ত্রণা আমার অন্য সন্তানদের মধ্যে। কেউ আমাকে ছাড়তে চায় না। বাকি জীবনটা তাদের বুকে আগলে রেখেই কাটিয়ে দিতে চাই।

সেদিনের আরেক শহীদ শিবির নেতা ফয়সাল আহমেদ শান্ত। তার ফেসবুক প্রোফাইলে লেখা আছে- যে হৃদয় শাহাদাতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করে, সে হৃদয় কখনো হতাশ হয় না।

শহীদ শান্তর মা কোহিনূর বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, আমার ছেলে আমার বুকের ধন ছিল। আমার ছেলের কষ্ট হবে, এজন্য আমি শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাকে কোনো কাজে হাত দিতে দিতাম না। আমার ছেলেটাকে ছেড়ে আমাকে একটা বছর কাটাতে হচ্ছে, সারাজীবন কাটাতে হবে, এ দুঃখ আমি কীভাবে সইব।

সেদিন আওয়ামী লীগের হামলায় নিহত দোকান কর্মচারী ফারুকের স্ত্রী সীমা আক্তার বলেন, আমার স্বামী তো নেই এক বছর। এখনো প্রাণ ঝড়ছে। আর কত নিরীহ মানুষের প্রাণ যাবে। আমি আমার স্বামীর হত্যা কারীদের ফাঁসি চাই

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ